দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে প্রবাসী ভাইদের কিছু অতুলনীয় কষ্ট আমি নিজের চোখে দেখেছি। ফেসবুকে প্রবাসী বিষয়ক অনেক লেখা দেখছি। ব্যক্তিগত ভাবে অনেকের সাথে আলাপ করি এসব ব্যাপারে। কারো কারো মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকে। এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সবার বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে। আমি সকল মতামতকে সম্মান জানাই। আমার সব সময় মনে হয়েছে সুযোগ পেলে আমার কিছু কথা গুছিয়ে সবার সামনে তুলে ধরা উচিত। তাই এ লেখাটির মাধ্যমে আমার কিছু অভিজ্ঞতা এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
এ লেখাটিতে সেসব প্রবাসীদের কথা বলতে চাচ্ছি যারা বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গমন করেন। তারা কায়িক পরিশ্রম করে নিজের রক্ত পানি করে থাকেন। তাদের কষ্ট শুরু হয়ে যায় যখন তারা দেশে পাসপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। সে ব্যাপারে আমরা কম বেশি সবাই জানি। আমার এ লেখাতে সেটা বিস্তারিত আর লিখলাম না। অনেক কষ্ট করে তারা পাসপোর্ট-ভিসা করেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দিনে যখন এয়ারপোর্টে আসেন বিদেশ যাওয়ার জন্য, তখন কোন গেট দিয়ে টার্মিনালে ঢুকবেন সেটার স্পষ্ট কোন তথ্য এয়ারপোর্টে পাওয়া যায়না। এয়ারপোর্টের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গেট আটকে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা কোন তথ্য সরবরাহ করতে পারেন না। টার্মিনালের বাইরে হয়ে যায় এক বিশাল লাইন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় কিছু টাকার পরিবর্তে সহজে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। অর্থাৎ তারা ঘুষ চান। আমার কাছেও চেয়েছেন। আপনি চিন্তা করেন, আপনি বিদেশে যাওয়ার আগে আপনার সব ব্যাগ-লাগেজ ইত্যাদি নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাকে বলা হচ্ছেনা কখন-কোন গেট দিয়ে ঢুকতে পারবেন। আপনাকে কোন তথ্য দেয়া হচ্ছেনা। এদিকে আপনার ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে। এমন অবস্থায় আপনার কাছে ঘুষ চাওয়াটা আর ছিনতাই করার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য পাইনা। এমন অবস্থায় অনেকেই হয়তো ঘুষ দিয়ে দিতে বাধ্য হন।
বাবার জমি বিক্রি করে, মা-স্ত্রীদের গয়না বিক্রি করে টাকা ম্যানেজ করে এরা বিদেশে যাচ্ছেন। একশ টাকা ঘুষের জন্য তারা লক্ষ টাকার বিদেশ গমনকে ভণ্ডুল করতে চান না। পরিবারের অনেক গুলা মানুষ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবারকে যে টেনে তুলতে হবে। এসব কিছু ভেবে তারা চুপ করে থাকেন। পরিবার থেকে হাজার মাইল দূরে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও তাদের সাথে যে আচরণ করা হয়, আমি তা দেখে লজ্জিত।
বিদেশে যাওয়ার পর প্রবাসী শ্রমিকদের আসল কষ্ট শুরু। শ্রমিকদের জীবন এখানে কল কারখানার মতো। বিরামহীন ভাবে তাদের দেহ চলতে থাকে কারখানার যন্ত্রের মতো। আমি সিংগাপুরে থাকি। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনটা দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করি, অনুভব করার চেষ্টা করি তাদের জীবনের চ্যালেঞ্জ। এখানে কনস্ট্রাকশনে কাজ করা শ্রমিকরা পিকআপ ট্রাকের পেছনে করে তাদের কাজের সাইটে গিয়ে থাকেন। হাতুড়ি, বাটাল, কোদাল, মানুষ সব একাকার। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারা কেমন যেন যন্ত্রপাতির সাথে মিশে গেছেন। যন্ত্রের মতো মানুষ গুলার দেহ থাকে পিকআপ ট্রাকে আর মনটা হয়তো থাকে হাজার মাইল দূরে পরিবারের কাছে। পরিবারের মানুষ হয়তো সঠিক ভাবে জানেন না তাদের কষ্টের কথা। হয়তো টেনশন করবে বলে প্রবাসীরা জানান না।
প্রবাসে শ্রমিকদের দৈনন্দিন কষ্টের কথা আরেকটু লম্বা করতে চাই। এক সময় আমার বাসার পাশে একটা কনস্ট্রাকশন সাইট ছিলো। কনস্ট্রাকশন সাইটে প্রায় দশটার মতো চল্লিশতলা আবাসিক দালান নির্মিত হয়। এখানে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করতেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার সুবাদে আমি বাসায় থাকতাম অনেক। দিনের বেলা শ্রমিকদের কষ্ট দেখতাম। তীব্র রোদে কাজ করা মানুষ গুলা দুপুরের খবর খেত মাটিতে বসে। কাউকে দেখতাম ফুটপাতে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। হাজার মানুষের স্বপ্নের ঘর বানানো মানুষ গুলো বিশ্রামের জন্য কোন ঘর পায়নি। এই মানুষ গুলার কোন ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স নেই। বার তেরো ঘণ্টা তারা ডিউটি করেন। সব কষ্ট পরিবারকে টেনে তোলার জন্য। শুধু লেখার মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্ট বর্ণনা করা আসলে সম্ভব না।
আমি আশা করছি উপরের লিখা থেকে পাঠক কিছুটা অনুভব করতে পারছেন প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনটা কেমন হতে পারে। তাদের রক্ত পানি করা অমানুষিক পরিশ্রমই আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আসার প্রধান উৎস। পরিষ্কার ভাবে এই মানুষ গুলো তাদের আয়ুর অনেকটাই উৎসর্গ করছেন বাংলাদেশকে গড়ার জন্য। তাদের এই ত্যাগের অবমূল্যায়ন দেখে আমি অনেক কষ্ট পাই। অবমূল্যায়নের কিছু উদাহরণ দেখেছি বাংলাদেশ হাইকমিশনে।
বাংলাদেশ হাইকমিশনে আমি অন্তত সাত থেকে আটবার গিয়েছি বিভিন্ন কাজে। অধিকাংশ মানুষ আসেন পাসপোর্ট রিনিউ করতে। প্রতিবার আমি প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা সেখানে অবস্থা করেছি। এ সময়ে আমি প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে অনেক গল্প করেছি। খুব ভালো লাগার একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, অধিকাংশ মানুষের মোবাইলে তাদের স্ত্রী সন্তানের ছবি ওয়ালপেপার দেয়া। কিছুক্ষণ পরপর তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছেন। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে হয়তো কোথাও ঘুরতে গেছেন, তারা ভিডিও কল করে বাবাকে দেখাচ্ছেন যে, তারা আনন্দ করছেন। বাবা দূর প্রবাস থেকে দেখছেন আর হাসছেন আর হয়তো মনে মনে ভাবছেন আজ তিনিও যদি আনন্দে যোগ দিতে পারতেন।
মাথা ঝাকিয়ে আসুন কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে আসি বাংলাদেশ হাইকমিশনে। এখানে প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা হয়। বসার জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই। ইনফরমেশনে কোন তথ্য জিজ্ঞেস করলে হাইকমিশনের মানুষরা সহজে ধর্য্যহারা হয়ে রাগ করে ফেলেন। কখনও কাজ বন্ধ করে দেয়ার ভয় দেখান। কখনও বা উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে উঠেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবাসী শ্রমিকরা কোন প্রতিবাদ করতে পারেন না, এই ভয়ে যদি কোন কারণে তাদের পাসপোর্ট আটকে দেয়া হয়? পরিবারের কথা ভেবে তারা চুপ করে থাকেন। যারা একটু মুরুবই গোছের, বয়স পঞ্চান্নো ষাটের কাছে, তারা অনেকেই অনেক টেকনিকালিটি বুঝেন না। ভাবতে অবাক লাগে, হাইকমিশনের দায়িত্বপালনে থাকা মানুষগুলা কেন মনে করেন যে, সবাই সব সঠিক তথ্য জেনেবুঝে এরপরে হাইকমিশনে হাজির হবেন? আপনারা এই অফিস খুলেছেনই বাংলাদেশিদের সাহায্য করার জন্য। আপনাদের আন্তরিকতার এত অভাব কেনো?
প্রশ্ন করলাম কারণ, একবার পাসপোর্ট রিনিউ করার লাইনে আমার পাশেই ছিলেন এক ভদ্রলোক (প্রবাসী শ্রমিক কী ভদ্রলোক হতে পারবেনা?)। তার বয়স পঞ্চান্নর উপরে হবে। তিনি বুঝতে পারছেন না কিভাবে ফর্মে সাইন করবেন। তিনি ভুলে গেছেন তার সাইন কী রকম। পরে আমি তাঁকে একটু হেল্প করলাম আগের পাসপোর্ট দেখে সঠিক ভাবে সাইন করতে। পরবর্তীতে আমি যখন ছবি তুলতে গেলাম, দেখি ভদ্রলোক ছবি তুলে ফেলেছেন, এখন ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যান করবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না ঠিক কোন ধারা অনুসারে আঙ্গুল স্ক্যান করতে হবে। নিমিষেই সেখানে বসে থাকা অফিসার তাকে ধমকানো শুরু করলেন। অফিসারের বয়স হবে বকা খাওয়া ভদ্রলোকের চেয়ে অন্তত পনের বছর কম। ভদ্রলোক মাথা নিচু করে স্ক্যান করে চলে গেলেন। হাইকমিশনের দায়িত্বপালনে থাকা মানুষগুলার অন্যতম কাজ প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাহায্য করা। আপনারা প্রতিদিন এই কাজ গুলো করেন; কিন্তু মনে রাখবেন যারা পাসপোর্ট রিনিউ করতে আসে, তারা প্রতিদিন আসেন না। তারা কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আসেন পাসপোর্ট রিনিউ করতে। কেউ কেউ হয়তো ছুটি না পেলে ওইদিনের বেতন পাবেন না। এই লোকগুলো ইতিমধ্যে অতি কষ্টের একটি জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ হাইকমিশন তো এক টুকরা বাংলাদেশ, এখানে কি তাদের একটু ভালো ব্যবহার দিয়ে আপ্যায়ন করা যায় না?
বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, ভাই প্রবাসী শ্রমিকরা প্লেনে উঠে অদ্ভুত আচরণ করে, বিদেশের রাস্তা ঘাটে উল্টাপাল্টা কাজ করে। এতে হয়তো আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে। আমি বুঝি ভাই আপনাদের কথা। কিন্তু একটু ভেবে দেখেন, প্রবাসী শ্রমিকরা হয়তো ভিন্ন একটা পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। ভিন্ন মানেই কিন্তু খারাপ বুঝাচ্ছিনা। হঠাৎ যখন বিদেশে গিয়ে তাদের জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়, হয়তো তারা অনেকেই বুঝে উঠেন না যে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেমন ব্যবহার করা লাগতে পারে। যদি আপনি-আমি সব বুঝে থাকি, তাহলে ধর্য্য ধরে প্রবাসীদের সাহায্য করা এবং ভুল হলে তাদের বুঝানো আমাদের কর্তব্য। হুট করে কাউকে ভুল বুঝে ফেলা আসলে খুব সহজ। আসুন একদম আজকে থেকেই আমরা আরেকটু সহনশীল হই।
সরকারের কাছে আমার আকুল আবদেন, দয়া করে এয়ারপোর্টে প্রবাসীদের কোন হেনস্তা যাতে না হয় এই ব্যবস্থা করুণ। বাংলাদেশের হাইকমিশন গুলোতে প্রবাসীদের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিশ্চিত করুণ। বিদেশে যাওয়ার আগে বিনামূল্যে কিছু ট্রেনিং প্রদান করুণ যাতে, বিদেশগামীরা যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশ অনুযায়ী সকল পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। সকল রকম দালাল চক্র নির্মূল করুণ, সরকারি ভাবে স্বল্প খরচে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
নতুন বাংলাদেশ তখনই সফল হবে, যখন আমরা নতুন ধারায় চিন্তা এবং চিন্তার বাস্তবায়ন করতে পারব ইনশাআল্লাহ।