আমার স্কুল, মতিঝিল মডেল হাইস্কুল এন্ড কলেজকে বিনোদন কেন্দ্র মনে করতাম। ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ৬ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেছি এই স্থানে। নির্মল বিনোদন কেন্দ্র বলার অন্যতম কারন হচ্ছে এখানকার অদ্ভুত-মজাদার শিক্ষকগন। অনেক বছর পর আজ আমার খুব ইচ্ছা করছে তাদের স্মৃতিচারণ করতে। অগোছালো কিছু কথা লিখার লোভ সামলাতে পারছিনা।
অন্যান্য স্কুলের মতোই মডেলের শিক্ষকদের কিছু মজাদার এবং ভয়ানক নাম ছিল। আমাদের কাশেম নামের দুইজন স্যার ছিলেন। একজন ছিলেন ভয়ানক রাগী, সবাই তাকে গরম কাশেম বলে ডাকতো। অন্যজন ছিলেন অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। স্বাভাবিক ভাবেই তাকে ঠান্ডা কাশেম বলে ডাকা হতো। নুরুল ইসলাম নামের এক স্যার ছিলেন, তিনি ছাত্রদের পাগলের মতো পেটাতেন। উনার ডাক নাম ছিলো নুরু পাগলা। আরো কিছু স্যার ছিল তাদের নামের শেষে নানা, মামা, চাচা বসানো হয়েছিল। যেমন আবুল মামা, মতিন নানা, দেলু মামা, ইত্যাদি। মতিন স্যারের বয়স ছিল ৮০। তাকে হয়তো নানা বলে মনে হতো, কিন্তু অন্য স্যারদের মামা বলে মনে হতোনা। তবুও ওই নামেই তাদের সবাই চিনতো। কিছু স্যারদের নামকে আবার শর্টকাটে ডাকা হতো। যেমন লুতফুর রহমানকে LRB, হারুন অর রাশিদকে HRC। একটা স্যারকে আন্ডারটেকার ডাকা হতো, কারণ উনার একটা 80cc মোটর সাইকেল ছিল। আন্ডারটেকার যেভাবে WWE এর attitude era তে মোটর সাইকেল নিয়ে স্টেজে আসতো, এই স্যারও স্কুলে ওই ভাব-সাব নিয়ে ঢুকতেন 80cc মোটর সাইকেল এ চড়ে। এছাড়া প্রিয় লাল গাইনকে Dear Red Cow, জাহাঙ্গীরকে জাইঙ্গা, বজলুর রাশিদকে বজা, সুনিল সোমকে বোম, হক স্যারকে হোক ব্যাটারি ইত্যাদি নাম ডাকা হতো। আমি সঠিক জানিনা কিন্তু আমার অনুমান শিক্ষকদের উপরে কোনো চাপা রাগের কারণেই ছাত্ররা এসব নাম তাদের দিয়ে থাকে। মজার মজার নাম ছাড়াও স্যারদের ঘিরে অনেক মজার ঘটনা ঘটতো। তেমন কিছু ঘটনায় আসি।
প্রথম ঘটনাটা আমাকে নিয়ে। ক্লাস এইট পর্যন্ত চুলের ব্যাপারে খুব উদাসিন ছিলাম। তেল/জেল কিছুই ব্যবহার করতাম না। চুল আচরানরও চেষ্টা করতাম না। অতঃপর ১দিন জাহাঙ্গির স্যারের ক্লাসে আমি প্রথম বেঞ্চে বসলাম। ক্লাস শুরুর কিছুক্ষন পর স্যারের চোখ পড়লো আমার উপরে। স্যার আমাকে বললেন, “এও বাবা, কি তোমার চুলে কোন তেল পানি নাই কেন? কি কবি হইসো? কবিতা লিখবানি; ডালিম গাছের তলেতে কে বসিল মুতিতে?”। এরপর থেকে চুল কখনও আমার এলমেলো হয়নাই।
নুরু পাগলা নামের যে স্যারটা ছিল তার কিছু জিনিস খুব আজব ধরনের ছিল। যেমন তিনি ক্লাসএ আসতেনএবং অর্ধেক ছাত্রকে দার করাতেন তারপর তিনি মারতেন। মারার পর জিজ্ঞাসা করতেন, ” তুই যে তর ব্যাগ ডেস্কে রাখসস লিখবি কই?” এই রহস্য কখনো উদ্ঘাটন করতে পারি নাই আমরা। লিখা লাগলে তো নামিয়ে নিবো ব্যাগ, কিন্তু মারামারি দরকার কি?
যারা ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠত তাদেরকে একটা খুব হাস্যকর কথা শুনতে হত।“তুমি এখন আর ক্লাস ফাইভে নেই, ক্লাস সিক্সে তুমি। এটা এখন আর প্রাইমারি স্কুল না, এটা হাই স্কুল। গতকালকে ৩ জনকে টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছে!” আমরা সবাই প্রথমে আতঙ্কে অস্থির। তিন জন কেন এমন ৩০০ জনকে টিসি দেয়া হয়েছে শুনেছি, কিন্তু কেন জানি আমি এবং আমার কোন বন্ধুও অত্যাধিক দুষ্টামির পরেও টিসি খাইনাই।
একজন বাংলা স্যার ছিলেন নাম যথাসম্ভব শফি। তিনি ক্লাসে এসে তার কনুইকে ক্যামেরার মত ধরে বলতেন “এইই পাব্লিগ।” তাকে ডাকা হত কবি স্যার বলে। কারন, তিনি কবিতা লিখতেন। তার কিছু কবিতার বইও ছাপা হয়েছিল। তার বাড়ি ছিল যশরের কপতাক্ষ নদের কাছে কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের বাড়ির কাছেই। বেশির ভাগ সময় আমরা বাংলা পড়তাম না। তিনি ক্লাসে আসলেই কেউ না কেউ তাকে জিজ্ঞেশ করত, “স্যার আপনার বাড়ি নাকি মধুসুদন দত্তের বাড়ির কাছে? স্যার একটু বলেন না উনার কথা ”। ব্যস হয়ে গেল। স্যার ছিল মধুসুদন দত্তের বিশাল ভক্ত। স্যার গল্প করতে করতে আমাদের ক্লাস শেষ করে ফেলতেন। যেদিন গল্প বলতে চাইতেন না, আমরা বলতাম স্যার আমাদের ৪ লাইন কবিতা লিখে দেন এখনই। স্যার মহা উৎসাহ নিয়ে কবিতা লিখতেন। কবিতা লিখে উনি আমাদের আবৃতি করে শোনাতেন। আমার স্যারকে কখনো নিরাশ করিনি, স্যারের কবিতা শুনে আমরা চিৎকার করে উঠতাম, হাততালি দিতে থাকতাম। স্যার খুব আনন্দ পেতেন। আমরা আরো বেশি আনন্দ পেতাম। পড়াশুনা না করেই ক্লাসের সময় শেষ করে ফেলার আনন্দ।
আমাদের স্কুলে ৪ বছর আরবি ব্যাকরন শিখতে হত। যে জন্য আমরা আরবিতে কিছু সাধারন কথা বার্তাবলতে পারতাম। যেমন, কাইফা হালুকা মানে কেমন আছেন, এ ধরনের সহজ কথা আর কি। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, আমাদের ক্লাসের এক সরল মনের ছেলে, আরবির শিক্ষক হক স্যারকে দেখে তার সাথে আরবি তে কথা বলতে যায়। ছেলেটা হঠাত করে স্যার এর সামনে গিয়ে বলে, “স্যার, স্লামুয়ালাইকুম, কাইফা হালুকা?” স্যার চমকে গিয়ে হাতের ছাতা দিয়ে ছেলেটির মাথায় বাড়ি মেরে বলেন, “হারামজাদা আমার সাথে মশকরা করস!” ছেলেটি যে মশকরা করেনাই আমি তা নিশ্চিত না। কিন্তু সে স্কুলে শেখা জ্ঞানের প্রয়োগের উপর যে বিশ্বাস হারিয়ে গেছে তা আমি নিশ্চিত।
ক্লাস সিক্সে আমাদের ক্লাস টিচার ছিল শাহজাহান স্যার। কেউ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়লে অথবা ৫টাকা দিয়ে বেত কিনে স্যারকে গিফট করলে স্যার তাকে ক্লাসের ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিতেন। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়াটা ছিল দেশের মন্ত্রী হওয়ার মত। কথা বললে বোর্ডে রোল ঊঠবেনা। স্যার পড়া ধরার সময় বোর্ড মুছতে গেলে পড়ার রক্ষা পাওয়া যাবে। হোমওয়ার্ক না আনলে ক্লাস এর সবার হোমওয়ার্ক তুলতে গেলে ক্যাপ্টেনের হোমওয়ার্ক দেখানো লাগবেনা, আর কত যে সুখ। লাভ-লসটা তখনই বুঝেছিলাম, যে জন্য স্যার এর কাছে না পড়ে শুধু ৫ টাকা দিয়ে একটা বেত কিনে স্যারকে দিলাম। স্যারও আমাকে ক্লাসের ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিলেন। আমাদের ক্লাসে প্রায় ১০ জন ক্যাপ্টেন ছিল, যদিও ছাত্র সংখ্যা ছিল ৬৫!
সুনিল সোম স্যার এর কমন “কি গাধার গাধা” এবং আরও ডায়লগ অনেক মজার ছিল যা লিখলে বোঝা যাবেনা, কিন্তু আমি এখনো অনেক ভাল অনুকরণ করতে পারি। চন্দন স্যার আমাদের মাকাল ফল বলত। রবিউল স্যার ভাবত আমরা সবাই ভবিষ্যতে রিকশা চালাব। হেম বাবু স্যার অঙ্ক করাতে করাতে এমন ভাবে অঙ্কের “বা” বলত যে আমরা অন্য কিছু মনে করতাম। এছাড়াও আর অনেক অনেক ঘটনা এবং ডায়লগ আছে যা লিখে শেষ করা যাবেনা।
পাঠান স্যার আমাকে ক্ষমা করবেন আমি দীর্ঘ ৫ বছর আপনার কাছে আপনার বাসার ঠিকানা জানতে চেয়েছি। কারন যাতে আপনি মনে করেন আমি আপনার কাছে পরতে চাই এবং আমাকে আপনি পড়া না ধরেন। সোম স্যার ক্ষমা করবেন আপনার পরীক্ষার হলের পাশে হিন্দি গান গাওয়ার জন্য। আরও অনেক কিছু বলার ছিল। এত অল্পের মধ্যে বলে শেষ করা যাবেনা, সব বলতে গেলে একটা পুরো বই লিখতে হবে।
অনেক স্যার হয়ত মারা গেছেন এবং অনেকে হয়ত বেচে আছেন। তাদের আমি অনেক স্রদ্ধা করি। আমি তাদের কাউকেই অস্রদ্ধা করতে লিখি নাই, আমি শুধু মাত্র একটু মনে করলাম কিছু মজার ঘটনা। এটা আমার স্কুল, এত টুকু অধিকার আমার আছে।
অক্টোবর ৪, ২০১৪
উত্তর বাসাবো, ঢাকা।
Thank you for sharing this insightful article! I found the information really useful and thought-provoking. Your writing style is engaging, and it made the topic much easier to understand. Looking forward to reading more of your posts!