প্রায় এক দশক আগে আমি ধানমন্ডি তিন নম্বরে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। আমি থাকতাম বাসাবোতে। ঢাকা শহরের কুখ্যাত যানজট থেকে বাঁচতে আমি তিন ভাগে রিকশা দিয়ে অফিসে যেতাম। এই তিন ভাগের শেষ অংশ ছিলো পরীবাগ ওভারব্রিজ থেকে ধানমন্ডি তিন নম্বরের অফিস পর্যন্ত। পরীবাগ ব্রিজ থেকে নামলেই সকালবেলা দেখা যেতো অসংখ্য রিকশাচালক তাদের রিকশা নিয়ে বসে আছেন। অফিস জয়েন করার কিছুদিন পর একদিন সকালে অফিসে যাচ্ছিলাম। পরীবাগ ব্রিজ পার হয়ে রিকশা খুঁজছি, হঠাৎ এক মজার দৃশ্য লক্ষ্য করলাম। অনেক রিকশাচালকদের মাঝে একজন বিশেষ রিকশাচালক। পরিষ্কার সাদা শার্ট পড়া একজন যুবক। চুল পরিপাটি করে আচরানো। তিনি বসে আছেন যাত্রীর সিটে। এবং বসে খুব আয়েশ করে সংবাদপত্র পড়ছেন। শার্টটা একটু ছেড়া থাকায় আমি ধারণা করলাম উনি চালকই হবেন। নাহলে তার ভাব ভঙ্গিতে বোঝার কোন উপায়ই ছিলনা তিনি রিকশাচালক কিনা। পরে আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাব। তখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম উনি এই রিকশার চালক। সেদিন তাকে নিয়েই আমি অফিসে গেলাম। রিকশা চালানো শুরুর আগে তিনি তার সংবাদপত্রটি রিকশার সামনে গুঁজে রাখলেন। সম্পূর্ণ রাস্তা খুব সুন্দর ভাবে রিকশাটা চালালেন। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে সেদিনের মতো আমি অফিস চলে গেলাম।
আমি যেখানে চাকরি করতাম, সেখানে আমার সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অফিসে যাওয়া লাগত। কোভিডের অনেক আগে হলেও সপ্তাহের বাকি দিন গুলো ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে পারতাম। যে দিন গুলোতে আমি অফিস যেতাম, আমি খেয়াল করা শুরু করলাম পরীবাগ ব্রিজ পার হওয়ার পর উপরুক্ত রিকশা চালককে রেগুলার বসে থাকতে। তাঁকে আমার কোন কিছু বলার প্রয়োজন হয়না। ভাড়া জিজ্ঞাসা করতে হয় না। আমি রিকশার সামনে গেলেই উনি আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে সংবাদপত্রটা সামনে গুঁজে রাখেন। আমিও কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করে সিটে উঠে বসি। এভাবে কিছুদিন চলার পর আমি জানতে পারি এই স্বল্পভাষী রিকশা চালকের নাম ইমরুল।
কয়েক মাসের মধ্যেই আমি ইমরুল ভাইয়ের পার্মানেন্ট যাত্রী হয়ে গেলাম। সকালে আমার হালকা দেরি হয়ে গেলেও আমি দেখতাম ইমরুল ভাই আমার জন্য বসে আছেন। আমিও কখনও সামনের দিকে ইমরুল ভাইকে না দেখলে অনেক খানি হেঁটে এগিয়ে গিয়ে নিশ্চিত হতাম উনি আছেন কী নাই। যেনো এক অসাধারণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং। আরো কিছুদিন পরে, আমি ইমরুল ভাইয়ের একটি অসাধারণ গুণ লক্ষ্য করা শুরু করলাম। তিনি অন্য রিকশাচালকদের মতো কোন গালিগালাজ করেন না। অন্য কোন রিকশাচালক উনার রিকশায় অন্যায় ভাবে ধাক্কা দিলে তিনি হয়তো প্রতিবাদ করতেন কিন্তু মুখ খারাপ করতেন না। ব্যাপারটা আমাকে অনেক অবাক করে। আমি ধারণা করতে শুরু করলাম, এ ব্যক্তির মধ্যে হয়তো কোন বিশেষ জ্ঞান আছে।
কিছু মাস যাওয়ার পর ইমরুল ভাই আমার জ্ঞান সংক্রান্ত ধারণা সঠিক প্রমাণ করলেন। হঠাৎ করে একদিন আমাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে বললেন যে উনি আগামী দুইমাস ঢাকায় থাকবেন না। আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম উনি কোথায় যাবেন। উনি বললেন সামনে উনার ছেলের জে এস সি পরীক্ষা। উনি চাচ্ছেন গ্রামে গিয়ে ছেলেকে অন্তত পরীক্ষার সময়টা চোখে চোখে রাখবেন। তাহলে ছেলের পরীক্ষার ফলাফল ভালো হবে আশা করছেন। হাজার হোক বোর্ড এক্সাম বলে কথা। উনার এই কথা শুনে আমি একটু ভেবাচেঁকা খেয়ে গেলাম। রিকশাচালক হয়েও তার এই দূরদর্শী চিন্তা আমাকে অনেক অবাক করলো।
প্রায় দুইমাস পর ইমরুল ভাইয়ের সাথে আবার দেখা। জিজ্ঞেস করলাম ছেলের পরীক্ষা কেমন হয়েছে। উনি বললেন আলহামদুলিল্লাহ ভালো। বললেন উনি গ্রামে না গেলে ছেলে মাঝে মাঝে দুষ্ট ছেলেদের সাথে উঠা বসা করে। তাই এই ব্যবস্থা। এর কিছুদিন পরে সকালে অফিস যাওয়ার পথে ইমরুল ভাইয়ের সাথে দেখা। দেখি উনি খুব খুশি। আমার হাতে একটা কাগজ ধরায়ে বললেন ছেলের রেজাল্ট দিসে। দেখি জিপিএ ৪ দশমিক ৫ এর মতো আসছে। বললাম ভাই আলহামদুলিল্লাহ আপনার কষ্ট সার্থক হয়েছে। একই সিস্টেম সামনের বোর্ড এক্সাম গুলোতেও করেন।
এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। প্রায় দুই বছর চাকরি করার পর, সেই দিনটি আসলো যেদিন আমার শেষ অফিস ছিল। আমি ভাড়া দেয়ার সময় ইমরুল ভাইকে বললাম ভাই আজকে আমার চাকরির শেষদিন এই অফিসে। এরপরে হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে কারণ আমি কিছুদিন পর ইনশাআল্লাহ বিদেশে চলে যাচ্ছি। উনি আমার কথা চুপচাপ শুনলেন। যাওয়ার আগে উনার সাথে হাত মেলালাম। এরপর উনি আসতে আসতে অন্য রিকশার ভিড়ে মিশে গেলেন। আমি কেমন জানি একটা চাপা কষ্ট অনুভব করলাম। এই কষ্টের মানে কী আমি জানিনা। এ ঘটনার পরে আমার আর ওই রাস্তায় অনেকদিন যাওয়া হয়নাই। আমি চলে গেলাম বিদেশে। এর দুইবছর পর একবার দেশে গেসি। আমি এবং আমার দুলাভাই একটা কাজে পরীবাগের দিকে গেলাম। পরীবাগ ব্রিজ পার হয়ে দেখি আবার সেই চিরোচেনা দৃশ্য। ইমরুল ভাই রিকশায় বসে সংবাদপত্র পড়ছেন। আমি দেখেই প্রায় চিৎকার করে উঠলাম আনন্দে। দুলাভাইকে পরিচয় করায়ে দিয়ে বললাম যে দেশে থাকতে আমি উনার পার্মানেন্ট যাত্রী ছিলাম। এরপর কিছুক্ষণ কথা বললাম উনার সাথে রিকশায় যেতে যেতে। তারপর আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আবার বিদায় নিলাম উনার থেকে।
দ্বিতীয় বিদায় নেয়ার পর পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। কেনো জানি আগের মতো কষ্ট লাগেনা। মনের ভেতরে একটা বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে যে ইনশাআল্লাহ হয়তো ইমরুল ভাইয়ের সাথে আবার কখনও দেখা হবে। আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষের সাথে আমাদের একরকম নীরব সংযোগ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় হয়তো আমরা খেয়াল করতে পারিনা। আল্লাহ ইমরুল ভাইকে এমন কিছু গুণ দিয়েছেন যে তিনি আমার স্মৃতিতে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন। আল্লাহ উনার সর্বাত্মক মঙ্গল করুন এই দোয়া রইলো।
ঠিক আমাদের জীবনটাও আল্লাহ এভাবে ডিজাইন করেছেন। বহু বার বহু জায়গায় বলেছেন কুরআনের যে, তোমার মুসাফির, গাছের তলায় বিশ্রাম রত মুসাফির। স্থান কাল পাত্র কিছুই থাকবে না এক জায়গায় কিন্তু ভালো কাজ , উত্তম আখলাক, সততা, ন্যায় এগুলো থেকে যাবে। ঠিক পরকালে ও এগুলোই যাবে সাথে। ইমরুল ভাই এর সততা, উত্তম ব্যবহার এর কারণেই আজকে উনি একজন মেমোরেবল ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ উনার সর্বোত্তম প্রতিদান নিশ্চিত করুন।