ছোটবেলায় বায়তুল মুকাররম মার্কেট স্থানটি আমি অনেক পছন্দ করতাম। মার্কেটটিকে তখন আমার কাছে অনেক ইন্টারেষ্টিং মনে হতো। এর প্রধান কারণ ছিলো ক্রীড়া ভবন থেকে শুরু করে জিপিও পর্যন্ত ফুটপাতের দোকান গুলো। দোকান গুলোতে জামাকাপড় থেকে শুরু করে খেলনা, ইলেকট্রনিক্স, জুতা, মানিব্যাগ, পকেট-ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি সব কিছু পাওয়া যেত। আমার কাছে জিনিস গুলো অনেক লোভনীয় মনে হতো। কখনো আব্বার সাথে বায়তুল মুকাররম গেলে আমি কিছু একটা কেনার বায়না ধরতাম। আব্বা আমাকে সহজে নিরাশ করতোনা। তাই আমি প্রায় সময়ই আব্বার সাথে বায়তুল মুকাররমে যেতাম কারণে অকারণে। সুযোগ পেলেই আমি আব্বাকে ধরে বসতাম বায়তুল মুকাররম নিয়ে যাওয়ার জন্য। একদিন শুনলাম আব্বা যাবেন বায়তুল মুকাররম, একটা শার্ট বানানোর জন্য। উনার পরনের শার্ট গুলো পুরোনো হয়ে গেছে নতুন বানানো দরকার। আমরা তখন বায়তুল মুকাররম মার্কেটের লাকি কর্নার নামের একটা দোকান থেকে শার্টের কাপড় কিনতাম। সেটা সেলাই করা হতো এলাকার টেইলার্সে। আমি আমার আব্বাকে কখনো রেডিমেড শার্ট পড়তে দেখিনি। উনি সব সময় শার্ট বানিয়ে পড়তেন, এখনো তাই করেন। সকালবেলা আব্বা রেডি হলেন বায়তুল মুকাররম মার্কেটে যাবেন। আমি উনাকে দেখে বললাম, আমিও যাবো। আব্বা আমাকে বললেন, রেডি হও। আমি আনন্দে আটখানা হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম আজকে ইন্টারেষ্টিং কিছু একটা কেনা যাবে। তৎক্ষণাৎ রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম আব্বার সাথে।
বায়তুল মুকাররম মার্কেট পৌঁছেই আমি যথারীতি অবাক হয়ে আসে পাশে দেখতে লাগলাম। আসে পাশের ফুটপাতের দোকানের জিনিসপত্র দেখে ইচ্ছা করলো সব কিছু কিনে নিয়ে যাই। বায়তুল মুকাররম অনেক পুরোনো মার্কেট। এখনকার শপিং মলের মতো গুছালো না। বেশ কনফিউজিং গলি-ঘুপচিতে ভরা একটা জায়গা। আমরা মার্কেটে ঢোকার একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম। এই গলিতে সব ঘড়ির দোকান। আব্বার হাত ধরে হাটছি আর আসে পাশে ঘড়ির দোকানে ঘড়ি দেখছি। ঘড়ি দেখতে দেখতে আমি হয়তো একটু মোহিত হয়ে পড়লাম। আব্বাকে বললাম, আব্বা আমি একটা ঘড়ি কিনবো। আব্বা এক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা চলো দেখি ঘড়ি। আমরা একটা ঘড়ির দোকানে ঢুকলাম। বিভিন্ন ঘড়ি দেখতে দেখতে আমার একটা ড্রেস ওয়াচ পছন্দ হলো। এগারো বছরের একটা বাচ্চার ড্রেস ওয়াচ পড়ার কোনো যুক্তি আমি খুঁজে পাইনা এখন। কিন্তু তখন আমার যুক্তি বোঝার বয়স ছিলোনা। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “না এটাই কিনবো আমি”। অবশেষে আব্বা দরদাম করে সাড়ে তিনশো টাকা দিয়ে ঘড়িটা আমাকে কিনে দিলেন। আমি অতি আনন্দে দোকানেই সেটা হাতে পড়লাম। আব্বাও খুব খুশি হলেন ব্যাপারটা দেখে। আমার ঘড়ি কেনা শেষ হলে আব্বাকে বললাম, চলো তোমার শার্ট কিনি। আব্বা বললেন “দেখি”। আমরা কিছুক্ষন মার্কেটে ঘুরার পর আব্বা বললেন, নাহ আজকে কিনবোনা শার্ট। আমিও আব্বাকে আর জিজ্ঞেস করলাম না কেন কিনবেন না। আমি তখন নতুন ঘড়ির আনন্দে আত্মহারা। নতুন ঘড়িতে বার বার সময় দেখতে দেখতে বাসায় ফিরলাম। আব্বার আর শার্ট কেনা হলোনা।
আব্বার “দেখি” শব্দটার আসল অর্থ বুঝতে পারিনি সেদিন। “দেখি” শব্দের আংশিক অর্থ বুঝতে লেগে গেছে প্রায় আরো বিশ বছর। দেখি শব্দটির পিছনে কত আত্মত্যাগ আর কতটা মমতা জড়ানো সেটা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন। শিশুরা নিষ্পাপ, তাদের অযৌক্তিক আবদার গুলোও নিষ্পাপ। আমার শৈশবের এই নিষ্পাপ ঘটনাটিকে আমার মাঝে মাঝে তীব্র নিষ্ঠুর মনে হয়। হয়তো আব্বা নিজের জন্য শার্ট না কিনে আমাকে ঘড়ি কিনে দিয়ে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছেন। হয়তো সব বাবা-মাই নিজের আগে সন্তানদের কথা ভাবেন। হয়তো আমি যেটা নিষ্পাপ-নিষ্ঠুরতা মনে করি, আব্বারা এতে আনন্দ পান। এখনো এই কথাগুলো মনে পড়লে বিবেকের কাঠগড়ায় আসামি হিসেবেই দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু সব সময়ই বিচারক থাকেন আব্বা। তিনি হাসিমুখে আমাকে বিনা-বিচারে খালাস করে দেন। আমি অসহায়ত্ত্ব অনুভব করি। প্রতিদান না দিতে পাড়ার অসহায়ত্ত্ব। কিন্ত আমি নিরাশ হইনা। এই অসহায়ত্ত্বই আমার চালিকা শক্তি। আমি বিশ্বাস করি জীবনের অনেক কঠিন সময় পার করার পেছনের শক্তি এটি। সকল সন্তান কাঠগড়ায় দাঁড়াক, অপরাধ হোক তাদের নিষ্পাপ নিষ্ঠুরতা গুলো।
এপ্রিল ২৪, ২০১৮,
মধ্য বাসাবো, ঢাকা।